মুখ ও মুখোশ – বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র
মুখ ও মুখোশ – বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “মুখ ও মুখোশ” (১৯৫৬) এক অবিস্মরণীয় নাম। এটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি (তৎকালীন পূর্ব বাংলার) মানুষের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে বড় পর্দায় ফুটিয়ে তোলার যাত্রা শুরু হয়। আজকের সমৃদ্ধ ঢালিউড বা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তি গড়ে দেয় এই সিনেমা।
নির্মাণ প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় তখনো কোনো উন্নত স্টুডিও, প্রশিক্ষিত শিল্পী বা আধুনিক সরঞ্জাম ছিল না। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নীতিমালা ঢাকায় চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে তুলতে অনীহা প্রকাশ করেছিল।
এই চ্যালেঞ্জের মাঝেই উদ্যমী নির্মাতা অবদুল জব্বার খান এগিয়ে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে “মুখ ও মুখোশ” নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
সিনেমার গল্পসংক্ষেপ
“মুখ ও মুখোশ” একটি সামাজিক ধারার চলচ্চিত্র। গল্পে ধরা হয়েছে সমাজের ভণ্ডামি, প্রতারণা, মানুষের প্রকৃত চেহারা বনাম মুখোশের আড়ালের দ্বন্দ্ব। সিনেমাটি নামেই যেমন প্রতীকী, তেমনি গল্পেও মানুষের আসল রূপ প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
গল্পে প্রেম, পরিবার, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার টানাপোড়েন উঠে আসে।
পরিচালক: অবদুল জব্বার খান
প্রযোজক: আবদুল জব্বার খান
প্রধান অভিনেতা/অভিনেত্রী:
- আজিম
- পিয়ারী বেগম
- জহুরুল হক
- নাজমা
- ইব্রাহিম খোকা
চলচ্চিত্রে অভিনয়শিল্পীদের বেশিরভাগই ছিলেন নবাগত, কারণ সে সময় প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাওয়া কঠিন ছিল।
সঙ্গীত
সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ওস্তাদ মোনিরুজ্জামান। গানগুলোতে ছিল শাস্ত্রীয় রাগের ছোঁয়া ও লোকজ সুরের সংমিশ্রণ। গানগুলো তখনকার শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
মুক্তি ও প্রতিক্রিয়া
১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার রূপমা হলে “মুখ ও মুখোশ” মুক্তি পায়। দর্শকদের কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল তুঙ্গে, কারণ এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাংলা ছবি।
মুক্তির পর সিনেমাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। এর সাফল্য প্রমাণ করে যে পূর্ব বাংলার দর্শকরা তাদের নিজস্ব ভাষায় চলচ্চিত্র চায়।
গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক মূল্য
-
প্রথম বাংলা সিনেমা – ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে এটি ইতিহাসের অংশ।
-
চলচ্চিত্র শিল্পের সূচনা – এর সাফল্যের পর পূর্ব পাকিস্তানে একে একে স্টুডিও গড়ে ওঠে এবং নতুন প্রযোজকরা এগিয়ে আসেন।
-
সাংস্কৃতিক প্রতীক – এটি বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলনের ধারা ও স্বাধীন চলচ্চিত্র শিল্প গঠনের ভিত্তি রচনা করে।
-
প্রেরণা – মুখ ও মুখোশের সাফল্যই পরবর্তীতে “হারানো দিন”, “আসিয়া”, “নাচের পুতুল” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছবির পথ প্রশস্ত করে।
উত্তরাধিকার
আজকের দিনে যখন আমরা “বেদের মেয়ে জোছনা”, “মনপুরা”, “পরাণ” কিংবা “প্রিয়তমা”র মতো ব্লকবাস্টার ছবির কথা বলি, তখন মনে রাখতে হবে এর শুরুটা হয়েছিল “মুখ ও মুখোশ” দিয়ে।
বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসে এই চলচ্চিত্রের স্থান তাই চিরকাল অমলিন।
“মুখ ও মুখোশ” কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্মঘণ্টা। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি প্রমাণ করে যে তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে পর্দায় অমর করতে সক্ষম। আজকের প্রতিটি সফল সিনেমার পেছনে এই ছবিটির ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
৭০ দশক হতে বর্তমান বাংলাদেশের যত ব্যবসাসফল সিনেমা

কোন মন্তব্য নেই